খোকা,
পাঁচপাত্তু-মোনায়েম খানের জন্যে আবদুলের আহাজারির নমুনা
- মোস্তাক
হোসেন
আবদুল
গাফফার চৌধুরী এক এক সময় জাতির ক্রান্তিকালে সময় বুঝে কখনো কলমের মুখ দিয়ে- আবার কখনো
উল্টো দিক দিয়ে লেখেন। যেমন ১৯৭১-এর জানুয়ারি মাসে সারা বাঙালি জাতি যখন আওয়ামী লীগের
নিরংকুশ বিজয়কে সংহত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে- স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে রুপান্তরিত করছে
স্বাধীকার ও স্বাধীনতার আরদুল গাফফার চৌধুরী তখন কলম ধরেছেন বাঙালির চেতনা বিরোধী আইয়ুব
পদলেহী গভর্নর মোনায়েম খান ও তার সৃষ্ট ত্রাস খোকা, পাঁচপাত্তুর পক্ষে। এখানে ১৯৭১-এর
জানুয়ারিতে আবদুলের নিজের লেখা কিছু অংশ এবং আমাদের বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো।
১৯৭১-
এর ১ জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার ‘তৃতীয় মত’ কলামে আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেছিলেন:
পাঁচপাত্তু নেই। খোকা নেই। তাতেউ যারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন আমি তাদের দলে নেই।
বাংলাদেশে মোনেমখানি আমলে যে চরিত্র বল মনুষ্যত্ববোধ ও মুল্যবোধকে হত্যা করা হয়েছে,
তার পুনরুজ্জীবন ও পুন:প্রতিষ্ঠা কোথায় আমাদের সমাজজীবনে, কিংবা শিক্ষা জীবনে? খবরের
কাগজ চোখের সামেনই খুলে দেখি পাবনায় ছাত্রহত্যা, চট্টগ্রামে আরো দু’জন ছাত্র ছুরিকাহত।
মাঝে মাছে সভযে নিজেকে প্রশ্ন করি, ছুরির রাজনীতিতে আবার হাত পাকাচ্ছে কোনো নতুন খোকার
দল? মোনেম খান তো ক্ষমতায় নেই। তাহলে এরা গোপন পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে কোথা থেকে? দৃস্কৃতিকারীরা
তো এবার লাটভবনে আশ্রয় নেয়নি- তাহলে আইনের শাসন সক্রিয় হতে এতা দ্বিধা ও বিলম্ব কেনো?
নিজের মনেই জবাব পেতে দেরি হয় না। বিষবৃক্ষের বীজ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই এখন হতে
যাচ্ছে মহীরুহ। ঢাকা শহরের খোকা আর পাচঁপাত্তু ছিলো মাত্র দু’জন কিংবা পাঁচজন। এখন
বাংলাদেশের সবদলে-সবখানে এরা ছড়িয়ে পড়েছে। আর বিষ্ময়ের কথা, আমাদের কোনো কোনো রাজনৈতিক
নেতা এই বিষবৃক্ষের বীজেই পানি সিঞ্চন করে করছেন। যে মুল্যবোধ মনুষ্যত্ববোধ আমাদের
সমাজজীবন আর রাজনীতি থেকে লুপ্ত হয়েছে- স্বৈরাচারিদের পতনের পর তাকে পুন:প্রতিষ্ঠার
বদলে হিংসার রাজনীতির ছুরিতেই শাণ দিচ্ছে অনেকে।
আমি
খবরের কাগজে পাবনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীতে ছুরি মারামারির খবর পড়ি আর ভাবি, খোকা ও পাঁচপাত্তুরের
এই অপঘাত মৃত্যুর কি প্রয়োজন ছিলো? দেশে যদি নতুন খোকার দলই তৈরি হবে, তাহলে এই পুরোনো
খোকাদের ঘৃণ্য করার, তাদের বিরুদ্ধে অধ:পাতের অভিযোগ তোলার কি অধিকার আছে আমাদের?
জানিনা
মওলানা ভাসানী কিংবা শেখ মুজিবের মতো জন নেতারা কি ভাবেন? প্রতিবেশী পশ্চিম বঙ্গরাজ্যের
হালের খবর তারা রাখেন কি-না তাও আমি জানিনা। গলায় গামছা বেঁধে সে বিপ্লব হয় না কিংবা
খ্রীষ্টিয়ন উদারতাকে প্রকাশ্য জনসভায় ব্যঙ করেও যে হিংসার রাজনীতির আগুন নেভানো যায়
না এ দুটি সত্য এ দু’নেতাকে স্মরণ করিয়ে দিলে তারা আমার ত্রুটি নেবেন কি-না জানিনা।
শুধু এ দু’নেতাকে অনুরোধ জানাই বাংলার মাটিতে নতুন খোকাদের আর যেনো জন্ম ন হয়। বাংলার
জাগ্রত তারুণ্যকে যেনো আর পথভ্রষ্ট হতে, চরিত্র নষ্ট হতে দেয়া না হয়।”
একাত্তরের
জানুয়ারি মাসে সারা বাঙালি জাতি যখন আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
নিরংকুশ বিজয়কে সংহত করে স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে স্বাধীকার তথা স্বাধীনতার দিকে নিয়ে
যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছে- তখন আওয়ামী লীগের তথাকথিত মিত্রের দাবিদার আবুদল গাফফার চৌধুরীর
আইয়ুব সহয়োগী হামিদুল হক চৌধুরীর পত্রিকায় বসে কলম ধরেছেন আওয়মী লীগের চরিত্র হননের
জন্যে। আহাজারি করেছেন আইয়ুবের পণপ্রত্যাখ্যাত গভর্ণর মোনায়েম খান আর তার পান্ডা পাঁচপাত্তু
খোকার জন্যে। যে পাঁচপাত্তু খোকার সৃষ্ট এসএসএফের সস্ত্রাসে স্তিমিত হয়ে গিয়েছিলো প্রায় ষাটের দশকের মধ্যভাবে বাঙালির প্রাণের
দাবি ৬ দফার আন্দোলন যাদের অকথ্য অত্যাচরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে বিরোধী দলের ছাত্রসংগঠনগুলোর স্বাভাবিক রাজনৈতিক তৎপরতা- যারা বিশ্ববিদ্যালয়
ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য দিবালোকে বিষাক্ত সাপ নিয়ে ঘোরাফেরা করতো ছাত্রছাত্রীদেরকে সন্ত্রস্ত
রাখার জন্যে সেই খোকা-পাঁচপাত্তুর জন্যে গাফফার চৌধুরী যখন ’৭১ সালের সেই সময়ে গফফার
চৌধুরী কাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে লিখতেন। ’৬৯-এর মহান গণঅভ্যুথানে উৎখাত হয়েছিলো
স্বৈরাচারী আইয়ুব-মোনায়েম চক্র- অবসান ঘটেছিলো দীর্ঘ এক দশকের পাষান পাথর সম একনায়কতন্ত্রের।
স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলেছিলো বাংলার মানুষ- কিন্তু তাতে যেনো মনোকষ্টের কারণ ঘটেছিলো
আজকের প্রগতিশীল কলামিস্টের দাবিদার গাফফার চৌধুরীর- তাই তার লেখায় ফুটে উঠে মোনেম
খানের পতনের জন্যে আপসোস- মোনায়েম খানেন পতন যে বাংলার মানুষের জন্যে কোন সুফল বয়ে
আনতে পারেনি, আওয়ামী লীগের বিজয় যে বাংলার মানুষের জন্যে সুদিন বয়ে আনতে পারবে না তাই জনগণের মধ্যে ছড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে গাফফার চৌধুরী
তার কলামে লিখেছেন ‘বাংলাদেশে মোনেমখানি আমলে যে চরিত্রবল, মানুষ্যত্ববোধ ও মূল্যবোধকে
হত্যা করা হয়েছে। তার পুনরুজ্জীবন ও পুন:প্রতিষ্ঠা কোথায় আমাদের সমাজ জীবনে কিম্বা
শিক্ষা জীবনে? তিনি অতি সুকৌশলে এবং জনগনের
মধ্যে ছড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে গাফফার চৌধুরী তার কলামে লিখেছেন ‘বাংলাদেশ মোনেমখানি আমলে
যে চরিত্রবল, মানুষ্যত্ববোধ ও মূল্যবোধকে হত্যা
করা হয়েছে। তার পুনরুজ্জীবন ও পুন:প্রতিষ্ঠা কোথায় আমাদের সমাজ জীবনে কিম্বা শিক্ষা
জীবনে?’ তিনি অতি সুকৌশনে এবং পাকিস্তনপন্থী হামিদুল হয় চৌধুরীর স্বার্থের পক্ষে দাঁড়িয়ে
সেদিনের বাংলার মানুষের আশা-আকাঙক্ষার প্রতীক বাংলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের প্রতীক
আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধকে বানিয়েছেন সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক- যার জন্যে লিখেছেন ‘মাঝে
মাছে সভয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি। ছুরির রাজনীতিতে আবার হাত পাকাচ্ছে কোন নতুন খোকার দল?
মোনেম খানতো ক্ষমতায় নেই। তাহলে এরা গোপন পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে কোথা থেকে? দুস্কৃতকারীরা
তো একবার লাটভবনে আশ্রয় নেয়নি- তাহলে আইনের শাসন সক্রিয় হতে এতো দ্বিধা ও বিলম্ব কেন?
আর এরপর সরাসরিভাবে এসবের দায়িত্ব বিরোধী দলগুলোর ওপর চাপাতে গিয়ে আবদুল লিখেছেন,
‘দেশে যদি নতুন খোকার দলই তৈরি হবে, তাহলে আইনের শাসন সক্রিয় হতে এতো দ্বিধা ও বিলম্ব
কেন? আর এরপর সরাসরিভাবে এসবের দায়িত্ব বিরোধী দলগুলোর ওপর চাপাতে গিয়ে আবুদল লিখেছেন,
‘দেশে যদি নতুন খোকার দলই তৈরি হবে, তাহলে পুরোনো খোকাদের ঘৃণা করার তাদের বিরুদ্ধে
অধ:পাতের অভিযোগ তোলার কি অধিকার আছে আমাদের?’
জানি
না মওলানা ভাসানী কিম্বা শেখ মুজিবের মত জননেতারা কি ভাবেন? এসব কথা লিখে গাফফার চৌধুরী
প্রকারান্তরে বাংলাদেশর তৎকালীন দুই শীর্ষনেতা মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু মুজিবকে যে
হেয় প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন এবং পাকিস্তানী শাসকবর্গের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন তা বলাই
বাহুল্য। লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে যে গাফফার চৌধুরী শেখ মুজিবের নামের আগে বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু
বলে ফেনা তুলে ফেলেছেন- তিনি ’৭১ এর জানুয়ারি মাসেও লিখেছেন শুধু শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু
লিখেননি। অথচ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভুষিত করা হয়েছিলো ’৬৯- এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুথানের
বিজয়ের মধ্য দিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি। অবশ্য বাঙালির প্রাণের দাবি ৬ দফা ও ১১ দফা বিরোধী
হামিদুল হক চৌধুরীর বেতনে চাকরি করে-এর চেয়ে বেশি কিছু গাফফার চৌধুরীর কাছে আশা করাও
বৃথা। ’৭০ ও ’৭১ সালের এই পুরোটা সময় জুড়েই গাফফার চৌধুরী চাকরি করেছেন। আয়ুবের দোসর
হামিদুল হক চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রত্রিকায় এবং অনেক লেখার মধ্যেই জনাব গাফফার এভাবে
সুকৌশলে ’৬৯- এর গণঅভ্যূথানের বিজয়ের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছেন- অপবাদ দিয়েছেন গণমানুষের
প্রাণপ্রিয় নেতাদের বিরুদ্ধে। ’৬৯ এর গণঅভ্যুথানের ফসল ’৭১-এর সাধারণ নির্বাচনের মধ্য
দিয়ে বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে গাফফার চৌধুরী যানিয়েছেন
‘হিসেব রাজনীতির ছুরিতেই শান’ বলেছেন ‘বিষবৃক্ষের বীজ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।’ তখন
আওয়ামী লীগ বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর ঘাড়ে চাপাতে চেয়েছেন আইয়ুব-মোনায়েমের
সৃষ্ট খোকা পাঁচপাত্তুর সন্ত্রাসের বোঝা। অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বাঙালিক স্বার্থের বিরুদ্ধে
এভাবে কলম ধরে গাফফার চৌধুরী মুলত: সেদিন বিভ্রান্ত করতে চেযেছিলেন বাঙালির স্বাধিকার
ও স্বাধীনতা আনোদলনকেই। ’৭১-এর জানুয়ারি মাসেও যিনি মনে করেন মোনায়েম খানের হয়েও বাঙালির
কি লাভ হলো- যিনি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বাঙালিক স্বার্থের বিরুদ্ধে এভাবে কলম ধরে গাফফার
চৌধুরী মুলত: সেদিন বিভ্রান্ত করতে চেযেছিলেন বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আনোদলনকেই।
’৭১-এর জানুয়ারি মাসেও যিনি মনে করেন মোনায়েম খানের হয়েও বাঙালির কি লাভ হলো- যিনি
আহাজারি করতে পারেন কুখ্যাত খোজা পাঁচপাত্তর জন্যে তার কাছ থেকে বাঙালি, বাংলাদেশ,
বঙ্গবন্ধু কিংবা শেখ হাসিনা সম্পর্কে হিতোপদেশ শোভা পায়না। কারণ জনাব গাফফার জ্ঞাতভাবে
ও অজ্ঞাতে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রন, স্বাধিকার, স্বাধীনতার প্রাথমিক প্রস্তুতিকেই কটাক্ষ
করেছেন তার উপরোল্লোখিত লেখায়। আর এই লেখায় সেদিন ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছিলো স্বাধিকার আন্দোলনের
প্রস্তুতিপর্ব। কারণ ভেতরে থাকার ভান করেই গাফফার এসব কাজ করেছেন। সুকৌশলে করেছেন।
প্রগতিশীলের ছাপমেরে লিখেছেন পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠির পক্ষে। বাঙালির বিপক্ষে,
আওয়ামী লীগের বিপক্ষে, বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষে মওলানা ভাসানীল বিপক্ষে- বাংলাদেশের সমস্ত
রানৈতিক দলের বিপক্ষে বাংলাদেশের সমস্ত রাজনৈতিক দলে বিপক্ষে। যার জন্যে তিনি লিখেছেন-
‘‘ঢাকা শহরে খোকা আর পাঁচপাত্তু ছিলো মাত্র দইজন কিংবা পাঁচজন, এখন বাংলাদেশের সবদলে-সবখানে
এরা ছড়িয়ে পড়েছে। এরচেয়ে জঘণ্য বাঙালি বিরোধী কথা আর কি হতে পারে?
@মোস্তাক
হোসেন, লেখক, সাংবাদিক।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন